মাওলানা আবদুল নূর | ইসলামে মিথ্যা বলা অত্যন্ত গর্হিত পাপ। এটি কবিরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন,
اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِیۡ مَنۡ هُوَ مُسۡرِفٌ كَذَّابٌ
নিশ্চয়ই সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ সঠিক পথে পরিচালিত করেননা। (সুরা গাফির: ২৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ صِدِّيقًا. وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا
তোমাদের কর্তব্য সর্বদা সত্য বলা। সত্যবাদিতা পুণ্যের দিকে পথপ্রদর্শন করে, আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পথপ্রদর্শন করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহ তাআলার দরবারে তাকে সত্যবাদী বলে লেখা হয়। তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপাচারের পথ দেখায়, আর পাপ জাহান্নামের দিকে পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ তাআলার দরবারে তাকে বড় মিথ্যুক বলে লেখা হয়। (সহিহ বুখারি: ৬০৯৪, সহিহ মুসলিম: ৬৫৩৩)
কিছু হাদিসে মানুষের মধ্যে ফয়সালা, মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে এবং দাম্পত্য জীবনে একে অপরের প্রশংসা ও ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে অসত্য কথা বলা জায়েজ বলা হয়েছে। উম্মে কুলসুম বিনতে উকবাহ ইবনে আবু মুআয়ত (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতে শুনেছি,
لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ وَيَقُولُ خَيْرًا وَيَنْمِي خَيْرًا
ওই ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে হলেও লোকেদের মধ্যে মীমাংসা করে, উভয় পক্ষকে ভালো কথা বলে, একের পক্ষ থেকে অপরকে ভালো কথা পৌঁছায়। (সহিহ বুখারি: ২৬৯২, সহিহ মুসলিম: ২৬০৫)
ইমাম মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, উম্মে কুলসুম (রা.) বলেন, আমি নবিজিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনটি কাজ ব্যতীত কোন কাজে কখনো মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনিনি, ১. শত্রুর বিরুদ্ধে মুসলিমের যুদ্ধের সময়, ২. বিবদমান দুপক্ষের মীমাংসা করানোর সময় এবং ৩. স্বামী স্ত্রীর সাথে এবং স্ত্রী স্বামীর সাথে কথা বলার সময়। (সহিহ মুসলিম: ২৬০৫)
আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
لاَ يَحِلُّ الْكَذِبُ إِلاَّ فِي ثَلاَثٍ يُحَدِّثُ الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ لِيُرْضِيَهَا وَالْكَذِبُ فِي الْحَرْبِ وَالْكَذِبُ لِيُصْلِحَ بَيْنَ النَّاسِ
তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত অসত্য বলা হালাল নয়, ১. স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে যেয়ে কিছু বলা, ২. যুদ্ধের প্রয়োজনে অসত্য বলা, এবং ৩. মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে কিছু অসত্য বলা। (সুনানে তিরমিজি: ১৯৩৯)
এ হাদিসগুলোর আলোকে আলেমরা বলেছেন, দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো রাখতে স্বামী স্ত্রীকে ও স্ত্রী স্বামীকে প্রশংসার ক্ষেত্রে, ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাড়িয়ে বলা নাজায়েজ নয়। যেমন স্বামী যদি স্ত্রীকে বলে ‘আমি তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি’, ‘তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী’, ‘আমার চোখে তোমার চেয়ে রূপবতী কেউ নেই’ এ সব কথা বলা জায়েজ। একইভাবে স্ত্রীও স্বামীকে বাড়িয়ে প্রশংসা করতে পারবে যদি তার অন্তরে তা নাও থাকে।
গুরুতর বিষয়ে, অন্যের হক নষ্ট করে, অন্যকে প্রতারিত ও বঞ্চিত করতে মিথ্যা বলার অবকাশ নেই। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারিতে লিখেছেন, আলেমরা এ ব্যাপারে একমত যে স্ত্রী বা স্বামীকে মিথ্যা বলা শুধু সেই ক্ষেত্রেই বৈধ যা তার কোনো হক নষ্ট করে না।
ইমাম নববি (রহ.) সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, স্বামী বা স্ত্রীকে মিথ্যা বলা বৈধ ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে, স্বামী বা স্ত্রীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে বা তাদের থেকে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা হারাম এ ব্যাপারে সব আলেমরা একমত।
উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে অনেকের মধ্যে এ ভুল ধারণা জন্মায় এবং অনেকে প্রচারও করেন যে দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রীর কাছে বা স্ত্রী স্বামীর কাছে যে কোনো মিথ্যা বলাই জায়েজ। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধরাণা।