1. admin@businessdigestbd.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

রাজনীতিতে শেখ হাসিনার পুনর্বাসন সহজ হবে না : এ কে এম শামসুদ্দিন

বিজনেস ডাইজেস্ট ডেস্ক :
  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৪৫ বার পঠিত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এক অস্থির সময়ে দেশের হাল ধরেছেন। দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর একে একে দাবিদাওয়া নিয়ে নবগঠিত এই সরকারকে যেভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়েছে, তাতে এসব দাবিদাওয়ার পেছনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের নাগরিকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। চারদিকের এসব নানামুখী অপতৎপরতা দেখে আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পতিত সরকারের লোকজনের হাত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্বভার গ্রহণের পর পরিস্থিতি ঘোলাটে করার যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর মধ্যে ১১ আগস্টের ‘জুডিশিয়াল ক্যু’-এর অপচেষ্টা অন্যতম। তিনি ওই দিন সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছিলেন, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ধারণা করা হচ্ছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল ক্যু করার চেষ্টা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ছিলেন এ ষড়যন্ত্রের পেছনে। দেশের গোয়েন্দা বিভাগ জুডিশিয়াল ক্যু-এর আগাম তথ্য পেয়ে যাওয়ায় আওয়ামী বিচারপতিদের পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়।

বাংলাদেশ আনসার সদস্যদের সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও দেশ অস্থিতিশীল করার আরও একটি অপতৎপরতা ছিল। দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব লোককে আনসার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, তাদেরই একটি অংশ ২৫ আগস্ট তাদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সচিবালয় ঘেরাও করে রাখে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল ও অন্যান্য দাবি পূরণের ব্যাপারে যথাযথ নিয়ম মেনে বিবেচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও তারা সচিবালয় ঘেরাও প্রত্যাহার করেনি। ঘটনার একপর্যায়ে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অতঃপর সেনাবাহিনী সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

এসব ঘটনার অবসান হতেই পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা চলে গেলেও তাঁর দলের অনেক নেতা-কর্মী দেশের মধ্যেই আত্মগোপন করে আছেন। ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষের ওপর নানা জুলুম-অত্যাচার চালানোর পর আন্দোলনের মুখে পতন হলেও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তাদের দোসর ও প্রেতাত্মারা এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। এই চক্রান্তকারী দোসররা যদি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে, তাহলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পথ সহজ হয়ে যাবে।

পার্শ্ববর্তী দেশের বহুল আলোচিত একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা ধরনের কথা আছে। বিশেষ করে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে সেখানে বসে কী করছেন, তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। এমনকি ভারতীয় পত্রপত্রিকায়ও সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করলেও পুলিশ ও প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি নিয়ে একধরনের অস্থিরতা অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা নানা উপায়ে নতুন সরকারকে চাপে রাখার অপচেষ্টা করছেন বলেও মনে করা হচ্ছে।

দেশে তৈরি পোশাকশিল্পে যে শ্রমিক অসন্তোষ বিরাজ করছে, তা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিরই একটি অপপ্রয়াস কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা ও আশপাশের পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকেরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ লেখা যখন লিখছি, তখন সাভারের আশুলিয়ায় শিল্পাঞ্চলের ২১৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের হাজিরা-বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম। গত তিন সপ্তাহের শ্রমিক বিক্ষোভের জন্য শিল্প খাতে আনুমানিক ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি জানিয়েছে। আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপের মাধ্যমে করা হয়নি। এটি শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একটি আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিল্প খাতের এই অস্থিরতা কমানো সম্ভব না হলে পতিত সরকার দেশে যে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা রেখে গেছে, তা আরও ভেঙে পড়বে।

যদিও পোশাকশিল্পের মালিকেরা বলেছেন, শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবেন, তবে এর জন্য শ্রমিকদেরও ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করতে হবে। তারপরও শ্রমিক অসন্তোষ কমছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে নৈরাজ্য তৈরি করতেই এই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে। তাঁদের মতে, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাকশিল্প এখন কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, এ জন্য একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার প্ররোচনায় পরিকল্পিতভাবে পোশাকশিল্প কারখানায় বিক্ষোভ, হামলা ও ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বিক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের কোনো সম্পর্ক নেই।

এ ধরনের নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে উসকানিদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া লোকজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলেও সীমান্তের ওপারে বসে হোয়াটসঅ্যাপে দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত তাঁর নেতা-কর্মীদের ইন্ধন জোগাচ্ছেন। সম্প্রতি এমন কয়েকটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে। তাতে তাঁর উসকানিমূলক বক্তব্য শোনা গেছে। তিনি ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেননি বলেও দাবি করেছেন। ভারতে বসে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন বক্তব্য না দিতে বলা সত্ত্বেও ভারত শেখ হাসিনাকে সে সুযোগ করে দেওয়ায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে জনমনে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এ ধরনের আচরণ নতুন নয়। দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশ থেকে যে সুবিধা নিয়েছে, তা ছিল তাদের প্রত্যাশারও বাইরে। শেখ হাসিনা নিজ মুখেই তা স্বীকার করে গেছেন। দুঃশাসন ও অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে সংবেদনশীলতার পরিবর্তে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসকের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটলে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ বাড়লে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। সীমান্ত হত্যাসহ নানা কারণে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের অনেক মানুষের মনে ক্ষোভ রয়েছে। এটা মনে করা হয় যে বাংলাদেশে অনুগত সরকার পেয়ে ভারত ১৫ বছর ধরে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, নিজেদের যতই গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করুক, বর্বর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়ে ভারত তার আসল রূপ উন্মোচন করেছে। এখন সেই পলাতক শাসককে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়ে এ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে যদি ভারতের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সহায়ক হবে না। ভারতের বরং উচিত হবে বাংলাদেশের মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। এ দেশের মানুষ আর কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী শাসনে ফিরে যেতে চাইবে না। বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই ছাত্র-জনতা এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আগামীর নতুন রাজনীতিতে শেখ হাসিনার পুনর্বাসন খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

Facebook Comments Box
এই ক্যাটাগরির আরও খবর