নিজস্ব প্রতিবেদক | উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। যেখানে ভারতে প্রতি দশকে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদারহরণ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিরল ঘটনা। এরপরও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা অযাচিতভাবে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা কখনো কখনো কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের হুমকিও দিয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবান্তর, অযাচিত বক্তব্য পুরো জাতিকে অবমাননা ও হেয় প্রতিপন্ন করার শামিল। যেখানে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে অবৈধভাবে চাকরি করে শত শত কোটি ডলার রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দিয়েছেন। বন্ধুভাবাপন্ন বা দায়িত্বশীল কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মন্ত্রীর কাছ থেকে এমন মন্তব্য আশা করা যায় না। মূলত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতের বশংবদ শেখ হাসিনা সে দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের সরকার এবং তাদের অনুগত গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে অনভিপ্রেত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের নানা ষড়যন্ত্রে পরোক্ষভাবে ইন্ধন দিচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ভারত সরকারের উদ্বেগ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ বলে মনে করেন বাংলাদেশের সচেতন জনগণ। বাংলাদেশে যখন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজার উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল, তখন ১২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং মন্দির অপবিত্রকরণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। তার এই বিবৃতি এবং উদ্বেগের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মন্দির অপবিত্রকরণ সম্পর্কিত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতি প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব এডভোকেট রূহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, এটি তাদের গভীর ষড়যন্ত্র ও মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। এ বছর বাংলাদেশে সাড়ে ৩২ হাজারের বেশি পূজা মন্ডপে উসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে পরিকল্পিত নাশকতা সৃষ্টি করে সরকার এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দায় চাপিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টার আশঙ্কা করা হয়েছিল। এ কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও পূজামন্ডপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছাত্র-জনতা এমনকি মাদরাসা শিক্ষক ও ছাত্রদেরও রাত জেগে পাহারা দিতে দেখা গেছে। ইতিপূর্বে ৫ আগস্টের বিপ্লবের পরও স্বার্থান্বেষি মহলের নাশকতা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও সম্পদ রক্ষায় ছাত্র-জনতা পাহারা বসিয়ে রক্ষা করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের তরফ থেকে হিন্দুদের প্রতি নিরাপত্তাহীনতার কোনো আশঙ্কা না থাকলেও পরিকল্পিতভাবে ঘটনা ঘটিয়ে সরকার এবং বিএনপি-জামায়াতের উপর দায় চাপিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ বন্ধ করতেই নিরাপত্তা ও নজরদারির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু নাশকতার ঘটনার প্রায় সবগুলোর সাথেই পতিত আওয়ামী লীগের কর্মী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবকরা জড়িত থাকার ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। ফরিদপুরে প্রতিমা ভাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত সঞ্জিত বিশ্বাস নামের একজন ভারতের নদীয়া জেলার বাসিন্দা বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
বাংলাদেশে গত ১৬ বছর ধরে একটি একদলীয় মাফিয়াতান্ত্রিক স্বৈরশাসন কায়েম রাখা এবং তা চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার পেছনে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ভূমিকা নতুন করে বিবৃত করা নিষ্প্রয়োজন। তারা বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার বাইরে গিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে একটি দল ও গোষ্ঠির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অচল ও আত্মঘাতী। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তার প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পালাবদলের পথ রুদ্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এক অনিবার্য রাজনৈতিক বাস্তবতা। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বসম্প্রদায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। তাদের সাথে সুর মিলিয়ে মোদি সরকারও ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান, সেখান থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ এবং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার নানামুখী ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা- থেকে ভারত সরকারের ভিন্ন ভূমিকাই প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের অমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উদ্বেগ প্রকাশ এবং গণমাধ্যমে পরিকল্পিত অপপ্রচার থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ভিন্ন বার্তা পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিংবা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ, এসবের কোনোটাই রক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে অহেতুক ব্লেইমগেম ও রাজনৈতিক গুটি খেলার চালে পরিণত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা ও প্রকারান্তরে সম্প্রীতি নিরাপত্তার সাথে বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় হিন্দু সম্প্রদায়কে অনাস্থা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা বা দূরভিসন্ধি বলেই গণ্য হচ্ছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। সাংবিধানিক কিংবা আইনগত নিরাপত্তা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই। সকলেই সমান অধিকার ও মর্যাদার হকদার। দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কোনো পক্ষের ক্ষমতার রাজনীতির শিকারে পরিণত হতে চায় না। এ ক্ষেত্রে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ও শান্তি-সম্প্রীতির স্বপক্ষে তাদেরও সক্রিয় জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।